কুষ্টিয়ায় নদীজুড়ে বালুর সাম্রাজ্য, বছরে ২০০ কোটি টাকার লেনদেন, সরকারের রাজস্ব মাত্র আড়াই কোটি
কুষ্টিয়ার পদ্মা ও গড়াই নদীজুড়ে চলছে বালুর রমরমা ব্যবসা। ২১টি বালুমহাল থেকে বছরে উত্তোলিত বালুর আর্থিক মূল্য কমপক্ষে দুইশ’ কোটি টাকা হলেও সরকারি রাজস্ব এসেছে মাত্র ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার মতো। অথচ বালুমহালগুলোয় রয়েছে অবৈধ দখল, সশস্ত্র পাহারা আর প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ।
নিয়ম না মেনে, এমনকি ব্রিজের নিচ থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারণে শতবর্ষী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, নির্ধারিত ফাউন্ডেশন স্তর থেকে বালু উত্তোলনে ব্রিজের পিলার দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
সরকার নির্ধারিত ২১টি বালুমহালের মধ্যে মাত্র চারটিতে উত্তোলন কার্যক্রম চালু, তাও মাত্র দুইটির ইজারা রয়েছে। বাকিগুলোতে পরিবেশগত, নাব্যতা ও আইনি জটিলতার কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেখানে প্রতিনিয়ত চলছে উত্তোলন—দিব্যি চলে যাচ্ছে ট্রাকভর্তি বালু।
রাতের অন্ধকারেই চলে মূল চুরি, পুলিশও জানে, কিন্তু নীরব
গভীর রাতে অনুসন্ধানে গিয়ে সংবাদকর্মীরা দেখতে পান—নিষিদ্ধ স্পট থেকেও প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে বালুবোঝাই ট্রাক। এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ সরাসরি আসে না, কিন্তু ফোনে দেন দামের দরকষাকষি।
একাধিক রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এসেছে, কেউ কেউ বলেছেন, “আমার নাম বললে দামে ছাড় পাবেন।” জেলা বিএনপির নেতাদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ দায় এড়িয়ে গেছেন, আবার কেউ বলেছেন, "পূর্বের লোকজনই এখন অভিযোগ করছে"।
স্থানীয়রা বলছেন, এই বালু যেন সোনার খনি—তাই একে ডাকা হয় ‘এল ডোরাডো’। একেকটি ঘাটে প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। বর্ষা-শুকনা, সব ঋতুতেই চলে উত্তোলন।
প্রশাসন জানে, তবুও নিরব
জেলার রাজস্ব কর্মকর্তা এবং ডিসি স্বীকার করেছেন সরকারের রাজস্ব ক্ষতির কথা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জানান, যেখানে বালু তোলা হয়, সেখানে যেতে হয় অস্ত্র প্রস্তুত করে, ফায়ারিংয়ের প্রস্তুতিও নিতে হয়। সাংবাদিকদের ওপর হামলার চেষ্টার কথাও উঠে এসেছে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—যখন জেলা প্রশাসন কোনো ঘাটের ইজারা দেয়নি, তখন কীভাবে হচ্ছে এতবড় চুরি? জেলা প্রশাসকের উত্তর, “চুরি তো চুরিই”।
প্রশাসনের ভেতরে বাইরে—সবখানে যেন এক ধরনের নীরবতা। ভয়ে কেউ অভিযোগ করতে চায় না। ফলে স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ অপব্যবহার হচ্ছে দেদারসে। শুধু পরিবেশই নয়, এই বালুবোঝাই ট্রাকের কারণে সড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনা আর প্রাণহানি।