নতুন রূপে জর্জিয়ার পঙ্কিসি ভ্যালি: সন্ত্রাসের জনপদ থেকে শান্তির পর্যটন কেন্দ্র
এক সময় পঙ্কিসি ভ্যালিকে ঘিরে নানা গুজব ও আতঙ্কজনক গল্প ছড়িয়েছিল। কেউ কেউ একে বলতেন সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু এখন সেই ভিন্ন চেহারা—জর্জিয়ার এই উপত্যকা শান্তি, আতিথেয়তা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নতুন এক গন্তব্য হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে।
কিস্ত সম্প্রদায়ের এই অঞ্চল আজ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গায় পরিণত হয়েছে। এখানকার গ্রামের পথ, পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য এবং কিস্ত রান্নার স্বাদ পর্যটকদের মুগ্ধ করছে। সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আকর্ষণ হলো দুইসি গ্রামের সাপ্তাহিক সুফি 'ধিকর' অনুষ্ঠান, যেখানে নারীরা আরবি ও চেচেন ভাষায় গাওয়া গানে, তাল ও ঘূর্ণনে ডুবে যান আত্মিক সাধনায়। ককেশাস অঞ্চলে এটি নারীদের দ্বারা পরিচালিত একমাত্র ধিকর অনুষ্ঠান।
দুই দশক আগেও এই অঞ্চলকে বলা হতো 'আইনহীন'। রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা চেচেন উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল হওয়ায় একে সন্ত্রাসের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। এমনকি গুজব রটে যে, ওসামা বিন লাদেন এখানে লুকিয়ে ছিলেন! এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ও রাশিয়ার চাপে জর্জিয়া সরকার এখানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায়।
পরবর্তীতে অনেক পরিবার পঙ্কিসি ছেড়ে ইউরোপে চলে যায়। তবে ২০১০-১৬ সালের মধ্যে কিছু যুবক সিরিয়ায় আইএসে যোগ দেওয়ায় পঙ্কিসি আবারও বিতর্কে আসে। তাদের মধ্যেই ছিলেন আইএস নেতা আবু ওমর আল-শিশানি।
তবে ২০২০ সালের এক ড্যানিশ রিপোর্টে বলা হয়—পঙ্কিসিতে অপরাধের হার খুবই কম, এবং এটি এক শান্তিপূর্ণ এলাকা। স্থানীয়দের কথায়, এখানকার পুলিশ চা পান করেই দিন কাটায়!
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছেন নাজি কুরাশভিলি। ২০১৩ সালে তিনি পঙ্কিসিতে প্রথম অতিথিশালা ‘নাজিস গেস্টহাউস’ চালু করেন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়কে উৎসাহিত করেন অঞ্চলটিকে পর্যটন মানচিত্রে আনতে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘পঙ্কিসি ভ্যালি ট্যুরিজম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’।
আজ পঙ্কিসিতে রয়েছে ৯টি গেস্টহাউস, বেশিরভাগই দুইসি ও জোকোলো গ্রামে। অতিথিরা এখানে ঘোড়ায় চড়ার, পাহাড়ে হাইকিং করার, ধিকর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার এবং স্থানীয় রান্না শেখার সুযোগ পান। মে থেকে অক্টোবর এই অঞ্চলে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
কিস্তদের খাবারও এখানে এক বড় আকর্ষণ। চেচেন ও জর্জিয়ান সংস্কৃতির মিশ্রণে তৈরি খাবারের মধ্যে রয়েছে ‘ঝিঝিগ গালনাশ’ (ডো ও ভেড়ার মাংসের ঝোল) ও ‘খিনকালি’ (লতাপাতাভর্তি ডাম্পলিং)। সব উপকরণই স্থানীয়—সবজি, মধু, দুধ ও চিজ।
নাজির গেস্টহাউসে রাতে একসাথে বসে অতিথিরা উপভোগ করেন কিস্ত খাবার, ঘরে তৈরি গোলাপ ফলের বিয়ার এবং একে অপরের গল্প। কেউ পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের, কেউ ঘোড়ায় চড়ার, কেউ বা ধিকর অভিজ্ঞতার স্মৃতি শেয়ার করেন।
পঙ্কিসি ভ্যালি এখন কেবল একটি পর্যটন গন্তব্য নয়—এটি আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়া এক সাহসী সম্প্রদায়ের অনন্য উদাহরণ, যারা প্রমাণ করে দিয়েছে ভয় ও কুসংস্কারের গণ্ডি পেরিয়ে গড়ে তোলা যায় এক শান্তিপূর্ণ, সংস্কৃতিময় সমাজ।