ঢাকা | বঙ্গাব্দ

বিলুপ্ত কনফেডারেশন কাপের ফ্লেভার রেখেই ‘নতুন ককটেল’ ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Jun 12, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন:

নতুন রূপে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ: কনফেডারেশন কাপের সমাপ্তি থেকে ৩২ দলের মহা আয়োজন

বছরখানেক আগেও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ছিল অনেকটাই ছোট পরিসরের একটি প্রতিযোগিতা, যাকে অনেকেই বার্ষিক একটি নিয়ম রক্ষার টুর্নামেন্ট বলতেন। ফিফা আয়োজক দেশ চূড়ান্ত করেই তাদের কাজ শেষ করত, আর বাকি দায়িত্ব পালন করত আয়োজক দেশের ফুটবল বোর্ড। প্রতিটি মহাদেশের চ্যাম্পিয়ন ক্লাবের সঙ্গে আয়োজক দেশের লিগজয়ী দল নিয়েই এটি মাঠে গড়াতো। তবে এবার সেই চিত্রে এসেছে বড় পরিবর্তন। বিশাল পরিসরে অনুষ্ঠিত হবে এবারের আসর, যেখানে থাকছে বিপুল অঙ্কের প্রাইজমানি। এই বড় পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে ফিফার আরেকটি জনপ্রিয় টুর্নামেন্টের বিদায় ঘণ্টা বাজার গল্প।


কনফেডারেশন কাপ: জন্ম, বিবর্তন ও বিলুপ্তি

ফিফা একসময় ‘কনফেডারেশন কাপ’ নামে একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করত। ১৯৯২ সালে ‘কিং ফাহাদ কাপ’ নামে এটি শুরু হয়েছিল। মূলত সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহর নামে চালু হওয়া এই টুর্নামেন্টের উদ্দেশ্য ছিল দেশটির ফুটবলে নবজাগরণ সৃষ্টি করা। ১৯৯২ ও ১৯৯৫ সালের আসরে সৌদি জাতীয় দলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি মহাদেশের চ্যাম্পিয়ন দেশ অংশ নেয়।

১৯৯৭ সালে ফিফা এই টুর্নামেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং এটির নতুন নামকরণ করে ‘কনফেডারেশন কাপ’। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এটি প্রতি দু’বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হতো। তবে, ২০০৫ সালের আসর থেকে ফিফা আয়োজক দেশ নির্ধারণে নতুন এক নিয়ম চালু করে: পরবর্তী বিশ্বকাপের আয়োজক দেশেই কনফেডারেশন কাপ অনুষ্ঠিত হবে, যাতে পরের বছর বিশ্বকাপ আয়োজনের একটা প্রস্তুতিও হয়ে যায়। ২০০৫ থেকে সর্বশেষ ২০১৭ সাল পর্যন্ত এভাবেই আয়োজিত হয় এটি। সর্বশেষ ২০১৭ ফিফা কনফেডারেশন কাপের শিরোপা জয়ী হয় জার্মানি।

বিপত্তি বাধে ২০১৫ সালে। ২০১০ সালেই ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে কাতারের নাম চূড়ান্ত হয়। কিন্তু কাতার রূপরেখা দেয় যে, আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের কনফেডারেশন কাপ কাতারে নয়, বরং এশিয়ার অন্য কোনো দেশে আয়োজিত হোক। এর পরিবর্তে, তারা প্রথমবারের মতো পরের বছর বিশ্বকাপের পরীক্ষামূলক আসর হিসেবে বড় পরিসরে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ধারণা ও প্রস্তাব তোলে, যা ২০২১ সালে কাতারেই অনুষ্ঠিত হবে। ফলস্বরূপ, ২০১৯ সালে ফিফা ‘কনফেডারেশন কাপ’ বিলুপ্ত ঘোষণা করে, রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসরটিই এর সর্বশেষ আসর হিসেবে বিবেচিত হয়।


নতুন রূপে ক্লাব বিশ্বকাপ: জাতিগত মেলবন্ধন ও বিশাল ক্যানভাস

কনফেডারেশন কাপ বিলুপ্ত হওয়ার পর এবং ছোট পরিসরের ক্লাব বিশ্বকাপ নামমাত্র কিছু দল নিয়ে আয়োজিত হওয়ায় আলোচনা শুরু হয় যে, কীভাবে এই দুই টুর্নামেন্টের সেরা দিকগুলোকে মেলানো যায় এবং একটি বড় পরিসরের আসর তৈরি করা যায়।

সমাধান আসে এমন এক ফরম্যাটের মধ্য দিয়ে, যেখানে জাতিগত মেলবন্ধনের বিশাল ফ্লেভার থাকবে – অর্থাৎ অনেক দেশের অনেক খেলোয়াড় অংশ নেবে। তবে এটি জাতীয় দলের টুর্নামেন্ট না হয়ে, ক্লাবভিত্তিক হবে। প্রচলিত ক্লাব বিশ্বকাপের আঙ্গিক থেকে এটিকে নতুন রূপ দেওয়া হয়।

আগের ক্লাব বিশ্বকাপে মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়নরা (উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, কোপা লিবের্তাদোরেস, এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগ, সিএএফ চ্যাম্পিয়নস লিগ, কনকাকাফ চ্যাম্পিয়নস কাপ এবং ওএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী) খেলতো। কিন্তু এবার ক্লাবের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬-৭টি থেকে ৩২টি করা হয়েছে। (শুরুর দিকের প্রস্তাবে দলের সংখ্যা ২৪টি ধরা হলেও পরে তা আরও বাড়ানো হয়)।

এর ফলে কী হবে? আগে শুধু উয়েফার চ্যাম্পিয়ন দলই খেলতো, যেখানে সীমিত সংখ্যক স্টারের খেলা দেখা যেত। প্রথম রাউন্ডেই ওএফসি কনফেডারেশনের একটি দল নিয়মিত বাদ পড়ত এবং অনেক সময় উয়েফার প্রতিনিধির সঙ্গে ওশেনিয়া অঞ্চলের ক্লাবটির দেখাই হতো না। এখন স্লট বেড়ে যাওয়ায়, বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড সিটি এফসি কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সানডাউনস ক্লাবের ম্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে দর্শকরা অনেকটা জার্মানি বনাম নিউজিল্যান্ড বা জার্মানি বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের আবহ উপভোগ করতে পারবেন।

২০২৬ বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকো। এবারের ক্লাব বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে মার্কিন মুলুকে। তাই বলা যায়, এটি শুধু কনফেডারেশন কাপের বিলুপ্তি নয়, বরং আগের ছোট পরিসরের ক্লাব বিশ্বকাপের ফরম্যাটেরও পরিবর্তন। ৩২ দলের বিশাল ক্যানভাস বিলুপ্ত হওয়া আগের দুই টুর্নামেন্টের সব ভালো দিক বজায় রাখার পাশাপাশি এর পরিধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।


ইউরোপিয়ান আধিপত্য, ব্রাজিলের সাফল্য ও নতুন প্রত্যাশা

২০০০ সালে শুরু হওয়া ক্লাব বিশ্বকাপে গত দুই দশকে ইউরোপিয়ান দলগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তবে দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাবগুলো চারবার শিরোপা জিতেছে। অপরদিকে, কনফেডারেশন কাপে ব্রাজিল ছিল দুর্দান্ত, হ্যাটট্রিকসহ চারবার শিরোপা জিতেছিল। এছাড়া একবার মেক্সিকো এবং বাকি শিরোপাগুলো ইউরোপের দেশগুলো জিতেছিল। সর্বশেষ আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি। উল্লেখ্য, এটি জাতীয় দলের আসর হলেও একটি মিথ প্রচলিত ছিল যে, ‘কনফেডারেশন কাপ জেতা দল পরের বছর বিশ্বকাপ জেতে না’। ফুটবল ভক্ত-সমর্থকরা এর সত্যতাও দেখেছেন।

মূলত, বিলুপ্ত এই দুই আসরকে এক করে, আরও কিছু নতুনত্ব যুক্ত করে ‘ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ২০২৫’ নতুন মোড়কে এসেছে। ফিফা বিশ্বকাপে আমরা অনেক অঘটন দেখেছি। ফ্রান্সকে হারিয়েছে সেনেগাল, এরকম অনেক ম্যাচ আছে। বোকা জুনিয়র্সকে অকল্যান্ড সিটি হারাতে পারবে কি না, তা বলা কঠিন। তবে পিএসজির সাথে যদি রিভার প্লেটের দেখা হয়, তাহলে তা ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনার অনুভূতির জন্ম দিতে পারে। ক্লাব ফরম্যাটও থাকলো, আর ৫০টি দেশের খেলোয়াড় এই আসরজুড়ে খেলবে – ক্যানভাসটা কত বড়, তা সহজেই অনুমেয়!

আগামী বছরের বিশ্বকাপের প্রস্তুতি তো বটেই, ‘ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ২০২৫’ একটি স্মরণীয় টুর্নামেন্ট হতে যাচ্ছে। এই শিরোপা জিতলে একটি ক্লাব যে প্রাইজমানি পাবে, তা বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা সর্বশেষ কাতার বিশ্বকাপ জিতেও পায়নি।


নিউজটি আপডেট করেছেন : Abdur Rabby

কমেন্ট বক্স