ঢাকা | বঙ্গাব্দ

‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটে’ জিম্মি হাসপাতালের রোগী ও স্বজনরা, দেখার কেউ নেই

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Jun 15, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন:

অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের জিম্মিদশায় সরকারি হাসপাতালগুলো: রোগী ও স্বজনদের সীমাহীন ভোগান্তি

ঢাকা/চট্টগ্রাম, ১৫ জুন: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ও তাদের স্বজনরা অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এই সিন্ডিকেটের বাইরে কোনো অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল থেকে রোগী নিয়ে বের হতে পারে না, যার ফলে মরদেহ ও রোগী পরিবহনে ভুক্তভোগীদের ২-৩ গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এই অনিয়ম চললেও এর প্রতিকারে কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।


চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করুণ চিত্র

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) এমন এক অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছিলেন যমুনা টিভির এক প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলা এক ব্যক্তি। চিকিৎসাধীন মায়ের মৃত্যুর পর মরদেহ ফেনীতে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে গিয়ে তিনি সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়েন। যেখানে ভাড়া ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা হওয়ার কথা, সেখানে মায়ের মরদেহ নিতে তাকে ১১ হাজার টাকা গুনতে হয়।

যমুনা টিভির ক্যামেরা এই ভুক্তভোগীকে কিছুক্ষণ অনুসরণ করে দেখে, চার-পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টা করেও কোনো অ্যাম্বুলেন্স ফেনীতে যেতে রাজি হচ্ছিল না। কারণ সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করতে পারে না; কোনো চালক রাজি হলে তাদের ওপর অত্যাচার ও হুমকি নেমে আসে।

ভুক্তভোগী ছেলেটি জানান, "মা মারা গেছে, এখন মরদেহ নেওয়ার জন্য গাড়ি লাগবে। কত ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই তারা বলছে এগারো হাজার। অথচ এই রাস্তার সর্বোচ্চ ভাড়া হতে পারে চার হাজার।"

তার মতো অন্যদের অভিজ্ঞতাও একইরকম তিক্ত। আরেক ভুক্তভোগী বলেন, "মরদেহ বের করতে হবে। কিন্তু হাসপাতালের এরা এত বেশি টাকা চায় যা আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। তাই একজনকে ম্যানেজ করে দেড় হাজার টাকা দিয়ে মরদেহ মেডিকেলের বাইরে নিয়ে যাই। পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে চকরিয়ায় নিয়ে যাই।"


অচল সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ও প্রকাশ্যে হয়রানি

এদিকে, চট্টগ্রামে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতে হাসপাতালের ৫টি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স অচল ফেলে রাখা হয়েছে। যমুনার ক্যামেরা দেখে অনেক ভুক্তভোগী সিন্ডিকেটের হয়রানির কথা তুলে ধরেন। রোগীর স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "সিন্ডিকেটটা কিসের, আমাদের কেন ওদের থেকেই অ্যাম্বুলেন্স নিতে হবে? আমি নাকি বাইরের গাড়ি এখানে আনতে পারব না? কেন?"

ভুক্তভোগীদের দাবি, বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিতে গেলে এখানে প্রকাশ্যে মারধর করা হয় এবং আটকে রাখা হয়। তাদের অভিযোগ, এই সিন্ডিকেটে হাসপাতালের লোকও জড়িত আছে।

অ্যাম্বুলেন্স চালকরা জানান, "এখানের ড্রাইভাররা আমাদের বাধা দেয়। রোগী নিয়ে আমরা হাসপাতালে ঢুকতে পারি, কিন্তু বের হওয়া নিষেধ। তাদের মাধ্যমে দামদর চূড়ান্ত হলে তবেই রোগী নিতে পারি।"

চট্টগ্রাম মেডিকেলের সামনে প্রায় আড়াইশো অ্যাম্বুলেন্স থাকে এবং সেখানে ভাড়ার তালিকাও রয়েছে। তবে অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি তা মানছে না। তারা রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তিন-চার গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে।


কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ও চলমান অনিয়ম

যদিও চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরুল কবির পলাশ ও যুগ্ম সম্পাদক মো. হাসান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, "সিন্ডিকেটের কিছু নাই। আমাদের সমিতির কারও কোনো স্বার্থ নেই এখানে। চাইলে আমরা আজই এগুলো ভেঙে দিতে পারি।" বেশি ভাড়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা দাবি করেন, ভাড়ার ক্ষেত্রে সবকিছু হিসেব করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এত অভিযোগ সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের হয়রানি বন্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না। চমেকের পরিচালক ব্রি. জে. তসলিম উদ্দীন বলেন, "আমাদের পার্কিংয়ে এক ঘণ্টা পরপর অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেগুলো অবৈধ অ্যাম্বুলেন্স আছে, সেগুলো বের করে দেওয়ার জন্যও কাজ করছে দায়িত্বরতরা।"

চট্টগ্রামের মতো রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্রও অভিন্ন। শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রায় সব জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতেই একই অবস্থা। এসব হাসপাতাল থেকে সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে কোনো অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে বের হতে পারে না। দামদরের ক্ষেত্রেও 'অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের' সদস্যরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তাই উপায় না পেয়ে স্বজনরা তাদের নির্ধারিত দরেই রোগী নিয়ে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।


নিউজটি আপডেট করেছেন : Abdur Rabby

কমেন্ট বক্স