ঢাকা | বঙ্গাব্দ

বাংলায় কথা বলায় বাংলাদেশে পুশ ইন, সমালোচনার মুখে নিজ দেশে ফিরলো ৫ ভারতীয়

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Jun 18, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন:

শুধু বাংলা বলার 'অপরাধে' ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে 'পুশ ইন'! মমতার হস্তক্ষেপে ফের নিজ দেশে ফেরত

ঢাকা, ১৮ জুন: শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার 'অপরাধে' পাঁচজন ভারতীয় বাঙালি শ্রমিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে 'পুশ ইন' করার অভিযোগ উঠেছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। ফজের, তাসলিমা, নাজিমুদ্দিন, মিনারুল এবং মুস্তাফা নামের এই পাঁচজনই ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের ওপর এই অমানবিক আচরণ করা হয়। সবারই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড রয়েছে, এমনকি কারো কারো ভারতীয় পাসপোর্টও আছে।

এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য বিধানসভায় সরব হলে বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। পরবর্তীতে সরকারি হস্তক্ষেপে এই পাঁচ ভারতীয় নাগরিককে আবার নিজ দেশে ফেরত নেওয়া হয়েছে।


অভিযোগ: পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলা, বেআইনি 'পুশ ইন'

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কেবল বাংলা ভাষায় কথা বলাটাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি ভারতীয় পরিচয়পত্র দেখালেও মুম্বাই পুলিশের কর্মকর্তারা সেইসব নথি ছিঁড়ে ফেলেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি মহারাষ্ট্র পুলিশ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাগদা থানার হরিহরপুর গ্রামের বাসিন্দা ফজের মন্ডল ও তার স্ত্রী তাসলিমা মন্ডলকে বাংলাদেশে 'পুশ ইন' করে। এরপর গত ১৪ জুন পরিবার বাগদা থানায় অভিযোগ জানায়। অভিযোগে বলা হয়, ভারতীয় সব নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও বেআইনিভাবে ফজের ও তার স্ত্রীকে বাংলাদেশে 'পুশ' করে বিএসএফ।

গত রোববার (১৫ জুন) এই খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হলে রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নের পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি বিএসএফকে জানানো হয়। পরদিন সোমবার সন্ধ্যায় দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ফজের ও তার স্ত্রীকে ভারতের হাতে তুলে দেয়। এরপর সে রাতেই তারা বাগদায় নিজেদের বাড়িতে পৌঁছান। ছেলে-বৌমাকে ফিরে পেয়ে ফজেরের পরিবার গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে। তাদের অভিযোগ, মুম্বাই পুলিশ গ্রেফতার করার পর তাদের আদালতে না তুলে বেআইনিভাবে বাংলাদেশে 'পুশ' করে।


কীভাবে ঘটলো ঘটনা: ভুক্তভোগীদের বর্ণনা

বাগদার বাসিন্দা ফজের মন্ডল জানান, হঠাৎ একদিন রাত ২টার দিকে নয়ানগর থানার পুলিশ তাকে ও তার স্ত্রী তাসলিমা মন্ডলকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর 'বৃহৎ মুম্বাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন' (বিএমসি)-এর একটি অফিসে চার-পাঁচ দিন রাখার পর তাদের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়। পরে বিএসএফের হাতে হস্তান্তর করা হলে, একদিন বিমানে করে দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় এবং সেখান থেকে গাড়িতে করে দক্ষিণ দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে 'পুশ' করা হয়।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ঢুকে কিছুদূর যাওয়ার পর বিজিবির হাতে ধরা পড়েন। বিজিবি তাদের ভারতে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। পরে গণমাধ্যমের খবরে বিষয়টি নিয়ে হইচই পড়ে গেলে গত ১৬ জুন তারা আবার ভারতে ফিরে আসেন।


একই ঘটনা কোচবিহার ও পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দাদের সাথেও

অন্যদিকে, কুচবিহার জেলার জামালদাহ সীমান্তেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। গত সোমবার (১৬ জুন) বাংলাদেশে 'পুশ ইন' করা তিন ভারতীয় নাগরিক, মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন মন্ডল ও মিনারুল শেখ এবং পূর্ব বর্ধমান জেলার বাসিন্দা মুস্তাফা কামাল শেখ, ফের নিজ দেশে ফিরে আসেন।

জানা গেছে, এই তিনজন মুম্বাইয়ে কাজ করতেন। সেখানেই বাংলাদেশি সন্দেহে স্থানীয় পুলিশ তাদের আটক করে। পরে ত্রিপুরা হয়ে কোচবিহারের সীমান্ত দিয়ে তাদের বাংলাদেশে 'পুশ ইন' করা হয়।

ভারতীয়দের বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর স্থানীয় পুলিশ কর্তব্যরত বিএসএফের সঙ্গে কথা বলে। পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে জামালদাহ সীমান্ত দিয়েই তাদেরকে দেশে ফেরানো হয়। ভারতে যাওয়ার পর গতকাল সোমবার মাথাভাঙার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সন্দীপ গড়াই তার অফিসে ওই তিন নাগরিককে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।

পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা মোস্তফা কামাল শেখ বলেন, "আমি মহারাষ্ট্রের নালাসোপরায় কাজ করি। গত ৯ জুন রাতে আমার বাসায় পুলিশ এসে আমাদের বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে নথি যাচাইয়ের কথা বলে। আমি তাদের ভারতীয় প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখাই। আমার মোবাইলে বাংলাদেশি ফোন নাম্বার দেখে তার ভিত্তিতে আমাদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে আখ্যা দেওয়া হয়। প্রথমে মিরা রোডে নিয়ে গিয়ে নথি যাচাই-বাছাই হয়, এরপর পামবেল, তারপর পুনেতে বিএসএফের সদর দফতরে পাঠানো হয়। পরে সেখান থেকে বিমানে করে আগরতলায় পাঠানোর পর বাংলাদেশে 'পুশ' করা হয়। সেখান থেকে বাড়ির ফোন নাম্বার নিয়ে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশের সহযোগিতায় আমরা দেশে ফিরে আসি।"

ফজের অভিযোগ করেন, মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে কলকাতায় আসার আগে বিমানবন্দরেই তাদের যাবতীয় ভারতীয় পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়, এমনকি তার দুটো মোবাইল ফোনও ভেঙে ফেলা হয়।


বিতর্ক নতুন নয়, তবে এবারের বিষয়টি ভিন্ন

তবে এই অভিযোগ নতুন নয়। মাঝেমধ্যেই মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হরিয়ানাসহ ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো থেকে আটকের পর বাংলাদেশে 'পুশ ইন' করার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাভাষী রাজ্যগুলির বাসিন্দাদের বাংলাদেশি বলে আখ্যা দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। এই বিষয়টি নিয়ে তখন আলোচনা হলেও নির্দিষ্ট সময়ের পর তা চাপা পড়ে যায়।

কিন্তু এবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। একদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এই অভিযোগ তোলেন। বক্তব্যে বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারকে নিশানা করতে দেখা যায় মমতাকে।

মমতা বলেন, "আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত যে, কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বললেই ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশি বলে তকমা দিয়ে সেদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলায় কথা বলাটা যেমন কারও কাছে গর্বের; ঠিক তেমনিই গুজরাটি, মারাঠি ভাষায় যারা কথা বলছে, তাদের কাছেও মাতৃভাষায় কথা বলাটা গর্বের।"

মমতা আরও বলেন, "একদিকে বাংলা কথা বলার জন্য আপনি ভারতীয়দের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করছেন, আবার অন্যদিকে ভোটার, প্যান এবং আধার কার্ডধারী মানুষদের জীবিকা নির্বাহের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন।"

উল্লেখ্য, গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার পরই গোটা ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত ও ধরপাকড়ে অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে বাংলাদেশি সন্দেহে গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, আসামসহ একাধিক রাজ্যে কয়েকশত ব্যক্তিকে আটক করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু করে ভারত সরকার। সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে কিছু না বললেও বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে 'পুশ ব্যাক' নীতি নিয়েছে ভারত সরকার। এর মধ্যে প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিক যেমন আছেন, তেমনি ভারতীয় নাগরিককেও বাংলাদেশি বলে 'পুশ ব্যাক' করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।


নিউজটি আপডেট করেছেন : Abdur Rabby

কমেন্ট বক্স