সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ২১ শতকের আধুনিক যুদ্ধের নতুন রূপ গোটা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে দুই শিবিরের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ‘হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল’ এবং প্রযুক্তিনির্ভর আঘাত গোটা পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও প্রাণঘাতী করে তুলেছে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ টানা ১২ দিন চলার পর আপাতত থেমেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছর পার হলেও এখনো অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সব সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’, সাইবার হামলা, ড্রোন আক্রমণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) প্রযুক্তির ব্যবহার এখন আধুনিক যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, সর্বশেষ ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ইসরায়েলিদের গৃহীত ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ ছিল আধুনিক কৌশলের দৃষ্টান্ত। গত ১৩ জুন ইরানের একাধিক পরমাণু স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী হামলা চালানোর আগে, দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে মোসাদ।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরাসরি সামরিক হামলা দিয়ে ধ্বংস করা হয়নি। বরং অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে ছোট আকারের বিস্ফোরকবাহী ড্রোন ব্যবহার করে সেগুলো ধ্বংস করা হয়। এই কাজে ইরানের ভেতরে আগে থেকেই গড়ে তোলা মোসাদের গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ জানিয়েছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইরানের রাজধানী তেহরানের ভেতরেই গোপনে ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। তিন বছর ধরে পরিকল্পনা করে এসব ড্রোন, বিস্ফোরক এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ইরানে পাচার করা হয়। বিশেষ ধরনের ‘কোয়াডকপ্টার’ ড্রোন ব্যবহার করা হয়, যা ট্রাক, কন্টেনার বা মালবাহী জাহাজের মাধ্যমে ইরানে আনা হয়।
এ ছাড়া এই ড্রোনগুলোকে আরও ভয়ংকর করে তুলতে এআই প্রযুক্তির সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং আঘাত হানার সক্ষমতা যোগ করা হয়। গোয়েন্দা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমেও সহযোগিতা নেয় মোসাদ।
একই ধরনের ‘হাইব্রিড কৌশল’ দেখা গেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেও। গত ১ জুন ইউক্রেনের ড্রোন স্কোয়াড রাশিয়ার ভেতর ঢুকে একযোগে পাঁচটি বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এতে রাশিয়ার প্রায় ৪০টি বোমারু ও নজরদারি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয় বলে দাবি করেছে ইউক্রেন। এসব হামলায়ও ছোট আকারের ‘কোয়াডকপ্টার’ ড্রোন ব্যবহার করা হয়, যা চোরাপথে রাশিয়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
এই ঘটনার পর ইউক্রেন দাবি করে, রাশিয়ার মোট বোমারু বিমানের এক-তৃতীয়াংশ এই হামলায় ধ্বংস হয়েছে। তদন্তে জানা গেছে, হামলার পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল ইউক্রেনেরই একজন গুপ্তচর, যিনি নিজ বাড়িতে ড্রোন তৈরির গোপন কারখানা চালাতেন। তার ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারেনি রুশ গোয়েন্দারা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই দুই সংঘাতই দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক যুদ্ধে শুধু সেনা সংখ্যা বা বড় অস্ত্র নয়, প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন এবং গুপ্তচর নেটওয়ার্কই হয়ে উঠছে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।