রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে যে ন্যায্যতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার আজ এক বছর পূর্ণ হলো। ৩৬ জুলাই যে স্বপ্ন, সম্ভাবনা আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল, এক বছরে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে সেই পথে? বৈষম্য কি কমেছে? কথা বলার স্বাধীনতা কি ফিরে এসেছে? গণতন্ত্র কি সত্যিই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে? এসব প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে সবার মনে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছায়া ফিরে আসে ২০২৪ সালের ১ জুলাই। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে একদল সাহসী শিক্ষার্থী দাঁড়ায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে, কণ্ঠে প্রতিবাদের বারুদ— “আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।”
শুরু হয় নতুন ইতিহাস রচনার লড়াই। কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপন পুনর্বহালের দাবিতে সরকারকে দেয়া হয় আল্টিমেটাম। সেই সঙ্গে অনলাইন ও অফলাইনে জনমত তৈরির কাজও চলে সমান্তরালে। ৭ জুলাই পালিত হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। একের পর এক বিক্ষোভ, অবরোধ, সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন আন্দোলনে। শুরু হয় অপপ্রচার। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কটূক্তি করেন।
কোটার বিষয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য ছিল, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?” — যা আরও উত্তাল করে তোলে ঢাকার রাজনীতি। ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বুকে গুলি খেয়ে শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়া হয়, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ আসে। তবুও আন্দোলন থামেনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মিছিলে যোগ দেন।
২১ জুলাই উচ্চ আদালত কোটা সংস্কারের রায় দিলেও মাঠের আন্দোলন থামেনি। পুলিশি হামলা, গুলি, গ্রেফতারের ভয়ে দমে যায়নি তরুণ প্রজন্ম। আন্দোলনের সমন্বয়কসহ ৬ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকিরা ঘোষণা করেন ৯ দফা দাবি। আন্দোলনে ধীরে ধীরে যোগ দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ঢাকার প্রবেশপথগুলো। বিদেশের মাটিতেও প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বন্ধের ডাক দেন।
৩ আগস্ট শুক্রবার স্মৃতি জাগানিয়া শহীদ মিনারে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতে ঘোষিত হয় এক দফা দাবি— “বাংলাদেশ আর শেখ হাসিনাকে চায় না।”
এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে স্বৈরাচারী শাসন। বাড়তে থাকে নিপীড়ন, হত্যা, লাশ পোড়ানোর মতো নির্মম ঘটনা। এর মধ্যেই ঘোষিত হয় লংমার্চ। ৫ আগস্ট ইতিহাস গড়ে, দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। অবশেষে শৃঙ্খল ভেঙে দেশের মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে।
এই বিজয়ের এক বছর পর তরুণ প্রজন্মের সামনে প্রশ্ন— বাংলাদেশ আজ কেমন আছে?
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে পেরেছি, এটা বড় অর্জন। কিন্তু নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজ এখনও শেষ হয়নি। হতাশার জায়গা আছে, তবে সম্ভাবনাও আছে। এই অবস্থান থেকে এগিয়ে নিতে হবে দেশকে।”
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ জীবন দিয়েছে, সেখানে যদি আপস করা হয়, জনগণ সেটা কখনোই মেনে নেবে না।”
পরিবারতন্ত্র, স্বজনপ্রীতি দূর করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটা কতটা পূরণ হয়েছে— এ প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম বলেন, “১৭ বছরের বঞ্চনার অবসান চেয়েছিল মানুষ। সেই প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হয়নি।”
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “আমরা শুধু শেখ হাসিনার পতন নয়, গোটা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পতনের কথা বলেছিলাম। সেই লক্ষ্যেই আমাদের লড়াই।”
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীরা এখনও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। চোখে তাদের স্বপ্ন— নতুন সোনার বাংলা। দেশের আপামর জনতাও পাশে আছে। তাদের বিশ্বাস, এই দেশে পরিবর্তন আসবেই। সেই আশায় পথ চেয়ে আছে গোটা জাতি।