ঢাকা | বঙ্গাব্দ

ভালোবাসায় মোড়ানো গল শহরের গল্প

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Jul 2, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন:

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণে, ভারত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত অপার্থিব সৌন্দর্যের নগরী গল। সমুদ্রের নীল জলরাশির কোলে গড়ে উঠা এই শহরটি ইতিহাস ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের অনন্য সংমিশ্রণ। সমুদ্রতটের কাছেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ডাচ ফোর্ট, যার পেছনে অবস্থিত গল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম—বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্থানে নির্মিত ক্রিকেট মাঠ। একদিকে ঢেউয়ের ঝংকার, অন্যদিকে শতাব্দী প্রাচীন দুর্গের ঐতিহ্য; এই গল শহরেই বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এই অসাধারণ শহরটিকে কভার করতেই আমার যাত্রা লঙ্কান দ্বীপে।

গলে পৌঁছানোর জন্য প্রথমে কলম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আসতে হয়। ১৪ তারিখ রাতে ফ্লাইট ধরে পৌঁছে, রাতের অন্ধকারে বিমানবন্দর থেকে বাস স্ট্যান্ডে যাত্রা শুরু। কলম্বোর বাস স্ট্যান্ড থেকে গলের জন্য বাস ধরতে হয়, যা প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ। যদিও রেলপথে সমুদ্র ঘেঁষে যাওয়া অনেক বেশি উপভোগ্য, দুর্ভাগ্যবশত ট্রেনের টিকিট মেলেনি। নির্ঘুম রাত পার করে বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম। সামুদ্রিক বাতাস আর ঢেউয়ের শব্দ মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে দিয়েও আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।

গলে নামার সঙ্গে সঙ্গেই হোটেলে ওঠার তাড়া। বাংলাদেশের প্রথম অনুশীলন দেখে নেওয়ার জন্য দ্রুত ‘টুকটুক’ বা সিএনজি নিয়ে শহর ঘুরতে বেরোলাম। টুকটুক চালিয়ে ‘ওল্ড ডাচ হাউজ’ পথে যাত্রা শুরু, যেখানে ৪৫০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। গল ফোর্টের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত গল ফোর্ট ক্লক টাওয়ার, আর এর সামনেই গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের ব্যস্ততা চোখে পড়ে।

টেস্ট চলাকালীন সময় সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজের কারণে ঘুরে দেখা যায় না, তাই ভোর ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সময় দিয়ে শহর আবিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এভাবেই চলল বাকি দিনগুলো।

গল শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল এর অসংখ্য মনোরম বিচ—উনাওয়াতুনা, জাঙ্গালাবিচ, মিরিসা, থাল্পে সহ আরও অনেক। এই বিচগুলোতে শান্তি আর নিরিবিলি পরিবেশ বিরাজ করে। বিশেষ করে ভোর কিংবা সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে সাগরের বিস্তৃতি যেন পুরোপুরি নিজের মনে হয়। ডালাওয়েলা বিচ শ্রীলঙ্কার অন্যতম সুন্দর বিচ হিসেবে পরিচিত, যেখানে আমি একাকী কিছু সময় কাটিয়েছি। ঢেউয়ের তালে গাছে ঝুলানো দড়িতে ‘পাম্প সুইং’ করার সাহসও দেখিয়েছি।

গল ফোর্টের এক প্রান্তে রয়েছে শহরের পুরাতন লাইটহাউজ, যা পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়। ১৮৪৮ সালে নির্মিত হলেও আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর ১৯৩৯ সালে পুনর্নির্মিত এই কাঠামোর শীর্ষ থেকে সমুদ্র, পাথুরে প্রাচীর এবং শহরের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। এক ফ্রেমে ইতিহাস ও প্রকৃতির মেলবন্ধন।

গল দুর্গের ভিতরে ডাচ ঔপনিবেশিক সময়ের ঐতিহাসিক ঘরবাড়ি, পুরানো গির্জা, হাতের লেখা সাইনবোর্ড এবং শতবর্ষী ক্যাফেগুলো চোখে পড়ে। এখানে ব্রিটিশ আমলের অল সেন্টস চার্চ ও মুসলিমদের মেহেরিয়া মসজিদ একসঙ্গে বিরাজমান। ছোট্ট শহর হলেও সময়ের অভাবে সব কিছু ঘুরে দেখা সম্ভব হয়।

গল শহরটি পরিছন্ন ও সুন্দর। রাস্তাঘাট সুশৃঙ্খল, ট্রাফিক পুলিশ খুব কম দেখা যায়, কারণ চালকরা আইন মেনে চলে। জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামিয়ে পথচারীদের পারাপার নিশ্চিত করা হয়। একদিন ভোরে দেখলাম, ছাত্র-ছাত্রীরা নিজ দায়িত্বে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে, যাতে অন্য যানবাহন অপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে চলাচল নিশ্চিত করে।

সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পর গল শহরে নেমে আসে গভীর নিঃশব্দতা। রাতের সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ মনকে প্রফুল্ল করে। নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই, তাই যেকোনো সময় ঘুরে বেড়ানো যায়। বর্তমানে গল মূলত অফ-সিজন, দর্শনার্থীর সংখ্যাও কম, তবে প্রকৃতি ও পরিবেশের সৌন্দর্যে কোনো ঘাটতি নেই। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হওয়ায় কিছু জিনিসের মূল্য অনেক বেশি। এক কাপ চায়ের দাম প্রায় ২০০ রুপি, আর ডিনারে সাধারণত ১৫০০ রুপির কাছাকাছি খরচ হয়। থাকার খরচ এলাকা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়; ডাচ কলোনি এলাকায় মাঝারি মানের হোটেলে থাকার খরচ বাংলাদেশি টাকায় ৩-৪ হাজার, অন্যত্র ১৫০০-২৫০০ টাকায় ভালো অবস্থান পাওয়া যায়।

শেষ পর্যন্ত গল দুর্গের মাঠে বাংলাদেশ দল টেস্ট জিততে পারেনি। ব্যস্ততার ফাঁকে স্টেডিয়াম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাহিন্দা কলেজেও যাই, যেখানে কিংবদন্তি ক্রিকেটার মারভান আতাপাত্তু ও লাসিথ মালিঙ্গা তাঁদের যাত্রা শুরু করেছিলেন। শতবর্ষী এই পাঠশালায় ভবিষ্যতের নতুন ক্রিকেটারদের প্রতিভাও খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের গল পর্ব শেষে বিদায় নেয়ার সময় ভেতর থেকে এক অজানা বিষাদের সুর বাজে। জানি, এসেছি মাত্র কিছুদিনের জন্য, তবুও এই ছোট্ট সময়েই গল শহর যেন হৃদয়ে একটা দাগ কেটে গেছে।

কলম্বো ফেরার পথে ট্রেনে বসে সমুদ্রের পাশে যাত্রা। ট্রেনের খটখট শব্দ মনকে এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরিয়ে দেয়। আগে জানতাম না, এমন শব্দও কতটা মধুর হতে পারে। গল আমার জীবনে এনে দিয়েছে নতুন পরিচয়, নতুন অভিজ্ঞতা—প্রকৃতির সৌন্দর্য, আকাশের বিস্তৃতি এবং সাগরের বিশালতা।


নিউজটি আপডেট করেছেন : Abdur Rabby

কমেন্ট বক্স